39867

‘কেঁদো না বাবা, তোমাকে আমি বিশ্বকাপ এনে দেব’

স্পোর্টস ডেস্ক: বাবাকে প্রথম কাঁদতে দেখেছিলেন তিনি ১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে ব্রাজিল হেরে যাওয়ার পর। এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে না? ফুটবলের রাজা পেলের পুরো নাম। স্মৃতিচারণে ‘কালো মানিক’ একবার বলেছিলেন, ‘আরও অনেক ব্রাজিলীয়র সঙ্গে সেদিন আমার বাবাও কাঁদছিলেন। বাবা বলতেন, পুরুষ মানুষকে কাঁদতে নেই। ওরা কাঁদে না। শক্ত থাকে। কিন্তু ওইদিন ব্রাজিলের হারে আমার বাবাও কেঁদেছিলেন।’

‘বাবাকে বলেছিলাম, কেঁদো না। আমি তোমার জন্য বিশ্বকাপটা জিতব। আট বছর পর আমি সুইডেনে। আমার গায়ে ব্রাজিলের জার্সি। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। আমার প্রথম বিশ্বকাপ জয়। আমার বয়স তখন ১৭। সেটি ছিল ঈশ্বরের পক্ষ থেকে আমার জন্য উপহার। জানি না সেদিন কেন বাবার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তোমাকে বিশ্বকাপটা এনে দেব।’ বাবাকে দেওয়া কথা পূরণ করার পর আরও দুবার ১৯৬২ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপও জিতেছিলেন পেলে। তিনবার আর কোনো ফুটবলার বিশ্বকাপ জেতেননি।

ads

পেলে কি শুধু একজন ফুটবলার ছিলেন। বিশ্বময় দুঃখী-দরিদ্রদের শুধু কি বিনোদন বিলিয়েছেন পায়ের কারুকাজে। চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং, অবিশ্বাস্য ডজ ও অনিন্দ্য সুন্দর গোলের সুরভি ছড়িয়েছেন ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’।

ষাটের দশকের শেষের দিকে নাইজেরিয়ায় তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। শুধু পেলের খেলা দেখার জন্য ১৯৬৯-এ দুদিন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল আফ্রিকার দেশটিতে সেসময়ের বিবদমান দুটি গ্রুপ। যাতে দুই পক্ষের মানুষ তার ফুটবল নৈপুণ্য উপভোগ করতে পারে।

ads

স্বভূমে সান্তোস ক্লাবের হয়ে ফুটবলে স্বপ্নযাত্রা শুরু করার পর খেলোয়াড়ি জীবনে অসংখ্যবার ইউরোপে খেলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ব্রাজিলের প্রতি আনুগত্য থেকে ইউরোপের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ফুটবল সম্রাট। ১৯৭৪-এ সান্তোসের হয়ে নিজের শেষ ম্যাচ খেলার পর অবসর নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন পেলে দেনার দায়ে জর্জরিত। তাই ৩৫ বছর বয়সে সাত মিলিয়ন ডলারে তিন বছর নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে খেলতে রাজি হন। সেটাই ছিল তার পেশাদার ক্যারিয়ারের শেষ তিন মৌসুম।

ফুটবলকে ‘সুন্দরতম খেলা’ বলে অভিহিত করতেন ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি। পড়ন্তবেলায়ও তার অবশিষ্ট ফুটবলশৈলী ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের বদৌলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল মন্থর গতিতে হলেও পল্লবিত ও পুষ্পিত হয়েছিল।

এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তোর জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ট্রেস কোরাকোয়েসের উপকণ্ঠে দোনা সেলেস্তেয়ে। তার বাবাও ছিলেন একজন স্থানীয় ফুটবলার। ফুটবলে পেলের হাতেখড়ি শৈশবে। মোজার ভেতর পত্রিকার পাতা গোল করে ভরে ফুটবল বানাতেন। সেটিই ছিল তার খেলনা। আশপাশের পিচ্চিদের মধ্যে দ্রুত তার নাম ছড়িয়ে পড়ে ভালো খেলোয়াড় হিসাবে। ব্রাজিলের ভাস্কো দ্য গামা ক্লাবের গোলকিপার বিলের নামের অনুকরণে তার নাম দেওয়া হয় পেলে। নামটি পছন্দ হয়নি তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বে সেই নামই তাকে পরিচিতি এনে দেয়।

সান্তোসে নিজের প্রথম পূর্ণ মৌসুমে তিনি ৩২ গোল করেন। এরপরই মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের জন্য ব্রাজিল দলের দরজা খুলে যায় তার সামনে। সুইডেনে প্রথম দুটি ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি হাঁটুর ইনজুরির দরুন। মাঠে ফিরেই কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের জয়সূচক গোল করার পর সেমিফাইনালে পেলে হ্যাটট্রিক করেন। ফাইনালে ব্রাজিল ৫-২ গোলে হারায় স্বাগতিক সুইডেনকে। দুটি গোল পেলের।

নিজের প্রথম বিশ্বকাপ জেতার পর পেলে নামটি এই গ্রহের ফুটবলানুরাগীদের ঠোঁটস্থ হয়ে ওঠে। পরের বার ১৯৬২ বিশ্বকাপ শিরোপাও জেতে ব্রাজিল। ১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ভরাডুবির পর পেলে ঘোষণা করেছিলেন, বৈশ্বিক আসরে নিজের শেষটা দেখে ফেলেছেন তিনি। ১৯৭০ বিশ্বকাপে খেলতে চাননি। কিন্তু দেশবাসীর আকুল আবেদন এবং সেসময়ের ব্রাজিলের অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান মেদিসির চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপে খেলেন পেলে। তখন তার বয়স ২৯। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বার বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে ব্রাজিল দেশে ফেরে। ম্যাচের প্রথম গোল করেছিলেন পেলে।

ad

পাঠকের মতামত