ইতিহাসের পাতায় মাছিমপুর আর আর ইনস্টিটিউশন
নিজস্ব প্রতিবেদক: একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হল শিক্ষা। দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্য পূরণে শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান অবলম্বন। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌছে দিতে পারে। তাই বলা যায় শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে পারে না।
কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলার ৫নং কলাকান্দি ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্কুল হলো মাছিমপুর আর আর ইনস্টিটিউশন। বিদ্যালয়টি ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠাতা শ্রী রাজ বিহারী পোদ্দার। সুদীর্ঘ ৮৯ বছরের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠানটি সফলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার একটি ইতিহাস আছে। তখন এই অঞ্চলে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। চোর ডাকাতের উপদ্রুপ ছিল পুরো এলাকায়।
রাজবিহারী পোদ্দারসহ তাদের পরিবারের সকলে ব্যবসা-বানিজ্যের সাথে জড়িত ছিলেন। উনারা সবসময় মানুষের উপকার এবং সেবা করতেন। জানা যায়, ভাষানিয়া গ্রামের কোন একজন শিক্ষক রাজ বিহারী পোদ্দারের কাছে এসেছিলেন কিছু ছাত্র জোগাড় করে দেবার জন্য। কারণ তখন ঐ শিক্ষকের কোন কাজ ছিল না। তখন রাজ বিহারী পোদ্দার পরিবারে তাঁকে রেখে দিলেন এবং কিছু ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করে দিলেন । তবে থাকা খাওয়া ও মাসে ৫ টাকা বেতন দিতেন পরিবার চালানোর জন্য। সেই থেকে তাঁর ভাবনায় এলো একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয়? কিন্তু তখন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ ছিল না। তবে মনে মনে স্থির করলেন স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করবেনই। কারণ তখন কলকাতায় যেতে হতো স্কুল অনুমোদন আনার জন্য। তাছাড়া তখন নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। কমপক্ষে ৫ মাইল দূরত্বে স্কুল থাকলে তখন স্কুল অনুমোদন দেওয়া হত না। তখন পাশে স্কুল বলতে ছিল জাহাপুর এবং মাথাভাঙ্গা স্কুল। আশেপাশে আর কোন স্কুল ছিল না।
কলকাতা বোর্ড থেকে সরকারি কর্মকর্তারা আসলো পরিদর্শনের জন্য, কিন্তু মাছিমপুর থেকে জাহাপুরের দুরত্ব ছিল মাত্র ৩ মাইল এবং মাথাভাঙ্গার দূরত্ব ছিল ৫ মাইল। এত কম দূরত্বে কোনভাবেই স্কুল অনুমোদন পাবে না। তখন ছিল বর্ষাকাল। তাই পোদ্দার সাহেবরা বুদ্ধি খাঁটিয়ে নৌকা ভাড়া করলেন এবং মাঝিকে বললেন, নৌকা যেন খুব তাড়াতাড়ি না পৌছে এবং কমপক্ষে যেন ৫ ঘন্টা লাগে এমন সময় ব্যয় করে জাহাপুর পৌছাতে। মাঝি তাই করলেন এবং ৫ ঘন্টায় জাহাপুর স্কুলে এবং ৬ ঘন্টা পর মাথা ভাঙ্গা স্কুলে পৌছালেন। তখন বোর্ড কর্মকর্তারা রাজি হলেন স্কুল অনুমোদন দিতে। যদিও জাহাপুর এবং মাথাভাঙ্গার বাবুরা এর বিরোধীতা করেছিলেন। এভাবে কষ্ট করে নিজের পয়সা খরচ করে রাজ বিহারী পোদ্দার পরিবার নিজের জায়গায় মাছিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাছিমপুর রামগতি রামনিধি ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্র ছিল না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র জোগাড় করে ১৩ (প্রায়) জন ছাত্র নিয়ে শুরু হলো পাঠদান। রাজ বিহারী পোদ্দার, নবীন পোদ্দার, বলরাম পোদ্দার, রাম কানাই পোদ্দার ও অবিনাশ পোদ্দার সকলে সম্মিলিতভাবে গড়ে ৫ একর জায়গা দান করে গড়ে তুললেন মাছিমপুর আর আর ইনস্টিটিউশন এবং মাছিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হলেও বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়। কোন এক সময় স্কুলের একজন পিয়ন বল্লার বাসা পোড়াতে গিয়ে পুরো স্কুলে আগুন ধরে যায় এবং স্কুল আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। তখন অত্র এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিগণসহ আপমর জনসাধারণ চাঁদা তুলে, কেউ কেউ মরিচ, ধান, ডিম যে যা পেরেছে স্কুলটিকে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আরও একবার ঝড়-তুফানে স্কুল বিরান প্রায় তখনও সকলের চেষ্টায় আবার গড়ে উঠে স্কুলের স্ট্রাকচার। স্কুলটি দুই দুই বার ধ্বংস হবার পরেও পোদ্দার পরিবারের সদিচ্ছায় টিকে যায় এবং আজও টিকে আছে।
এই স্কুল থেকে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন হাজার ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। এদর মধ্যে কেউ হয়েছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, স্কুল শিক্ষক, সচিব, উকিল, সাংবাদিক, বিভাগীয় কমিশনার, পাইলট, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি পেশায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তি। এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী এম কে আনোয়ার। তিনি বিনা বেতনে এই স্কুলে চাকুরি করেছিলেন ২ বছর। এই স্কুল থেকে লেখাপড়া করে অনেক ছাত্র-ছাত্রী রাষ্ট্রের অনেক উ”চপদে আসীন হয়েছেন। এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন মাছিমপুর গ্রামের কৃতি সন্তান বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সাবেক উপ সচিব আ: মতিন খান (মাছিমপুর), সাবেক চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার মো. খলিলুর রহমান (জয়পুর) , আলী হোসেন (মনাইকান্দি), কৃষি মন্ত্রনালয়ের সচিব মো: মোবারক হোসেন (মাছিমপুর) , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার আ: মতিন (মাছিমপুর) ও পাইলট শাহাজাহান (মাছিমপুর) এর মতো আলোকিত মানুষজন।
সেই গৌরবজ্জ্বল পথচলায় যোগ হলো আরেকটি নতুন পালক সেলিমা আহমাদ মেরী। হোমনা-তিতাসের অভিভাবক জাতীয় সংসদ সদস্য ও বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা সিআইপি সেলিমা আহমাদ মেরী মাছিমপুর আর আর ইনস্টিটিউশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। যা স্কুলটির জন্য একটি মাইলফলক। স্কুলটির ৮৯ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোন জাতীয় সংসদের কোন সদস্য মাছিমপুর হাইস্কুলের সভাপতি হলেন। এতে এলাকাবাসীর মনে খুশির আমেজ বিরাজ করছে। এলাকাবাসি আনন্দিত। এলাকাবাসী বিশ্বাস ও আর তাঁর হাত ধরে স্কুলটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তাছাড়া বিদ্যোৎসাহী সদস্য হয়েছেন প্রতিষ্ঠাতার নাতি আ’লীগ নেতা বিবেকানন্দ পোদ্দার (বিবু)।
এর আগে যারা সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আ: খালেক, শ্রী রাখাল চন্দ্র পোদ্দার (তিনি ৫ বার সভাপতি ছিলেন) , সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খাজা মোহাম্মদ আলী, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার আ: রশিদ সরকার, সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. অহিদুল ইসলাম, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মো. পারভেজ হোসেন সরকার (তিনি দুই বার ছিলেন), সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান মুন্সী মো: মুজিবুর রহমান ও মো. আলম সরকার প্রমুখ।
যদিও বিগত ৭-৮ বছর যাবৎ বিদ্যালয়টি পেছনের দিকে অগ্রসরমান। তিতাস উপজেলার অন্যান্য স্কুল গুলোর থেকে পিছিয়ে পড়েছে বলা যায়। দিনকে দিন ফলাফলসহ শিক্ষার মান নিচের দিকে যাচ্ছে। কেন এই বেহালদশা? এর কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে নানাবিদ কারণ থাকলেও সবচেয়ে বড় কারণ হলো বিদ্যালয়টিতে ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল এবং বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব। অদক্ষ এবং প্রশিক্ষণবিহীন খন্ডকালীন শিক্ষক (যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রায় ক্ষেত্রে এসএসসি কিংবা এইচএসসি) দিয়ে পাঠক্রম চালানো হচ্ছে। ফলে ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে। জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জিত হচ্ছে না। তবে ২০১৬ সালে স্কুলটি তিতাস উপজেলায় ফলাফলের ভিত্তিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে এবং মন্ত্রনালয় থেকে ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার পায়। ২০১৮ সালে স্কুল থেকে জিপিএ ৫ পায় মোট ১৭ জন। যা একটি মাইলফলক।
স্কুলটি পিছিয়ে পড়ার দ্বিতীয় কারণটি হলো ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে রাজনীতি। বিগত ৭-৮ বছর ধরেই এই কমিটি নিয়ে চলে আসছে রাজনীতির খেলা। কমিটিতে আসার জন্য বিভন্ন পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। অযোগ্য ও অশিক্ষিত লোকজন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হওয়ায় তারা পারছেন না কাংখিত ভূমিকা রাখতে। যিনি এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করে এই অঞ্চলের ৪২টি গ্রামের মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে চলার পথ দেখিয়েছেন, সেই ব্যক্তিটির জন্ম দিবস কিংবা মৃত্যু দিবস কোনটিই পালন করেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাঁর সমাধি স্থলটি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে রয়েছে। দেখার কেউ নেই। নেই কোন বাউন্ডারি ওয়াল কিংবা বেড়া। এ প্রসঙ্গে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. মাহফুজুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমরা বিগত কমিটির সময়ে কয়েকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পরিবারই বলতে পারছেন না প্রতিষ্ঠাতার জন্ম-মৃত্যুর তারিখ। তবে আমরা এ বছর চেষ্টা করব পালন করতে। আর সমাধি স্থলটি যেখানে আছে সেখানকার পাশবর্তী কারো সাথে জায়গা নিয়ে ঝামেলা আছে। এটা বসে সমাধান করলেই আমরা বাউন্ডারী করতে পারব।
তবে ধীরে ধীরে সমস্ত সমস্যা ওভারকাম করার চেষ্টা করছেন প্রধান শিক্ষক মাহফুজুর রহমান চৌধুরী ও সহকারি প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার বকুলসহ অন্যান্য শিক্ষকরা। তারা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপাড়ার মান বৃদ্ধি এবং ভালো ফলাফল অর্জনে।
বর্তমানে স্কুলটিতে প্রায় ২,২০০ ছাত্র-ছাত্রী, এমপিও ভূক্ত শিক্ষক আছেন ১৪ জন এবং খন্ডকালীন শিক্ষক আছেন ২৪ জন। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে অন্য যে কোন স্কুল থেকে এগিয়ে রয়েছে স্কুলটি। স্কুলটিতে রয়েছে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র। যা সকলের জন্য একটি গৌরবের বিষয়।