32887

ইউক্রেন যুদ্ধে ভিন্নমতেই ‘একমত’ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউক্রেন ইস্যুতে ভিন্ন অবস্থান নেওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাশিয়ার সমালোচনা না করায় ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান চাপ প্রয়োগের পরিস্থিতিতে দুই নেতা ভার্চুয়াল বৈঠক করলেন। এই বৈঠক পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না এবং হোয়াইট হাউজের অনুরোধে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি ভূ-রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বৈঠকের আগে বাইডেন ভারতের অবস্থানকে এক ধরনের নড়বড়ে হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এক মার্কিন কর্মকর্তা সতর্ক করে ভারতকে অবহিত করেছিলেন যে মস্কোর সঙ্গে বৃহত্তর কৌশলগত অবস্থানের পরিণতি হবে তাৎপর্যপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান চাপের পরও ভারত নিজেদের অবস্থানে অটল থেকেছে। যুদ্ধ অবসানে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে দিল্লি। এখন পর্যন্ত সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করেনি দেশটি, কিন্তু প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে কিছু শক্তিশালী শব্দ ব্যবহার করেছে।

ads

ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ২+২ ডায়লগ চলাকালে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২+২ ডায়লগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন অংশগ্রহণ করেন।

আলোচনা নিয়ে উভয় পক্ষের বিবৃতিতে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ইউক্রেন ইস্যুতে একে অপরের অবস্থান বুঝতে পারার অভিপ্রায়।

ads

কন্ট্রোল রিস্কস কনসালটেন্সির দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক প্রত্যুষ রাও জানান, সম্পর্ক যখন সংবেদনশীল পর্যায়ে তখন এই বৈঠক ও সফর অনুষ্ঠিত হলো। তিনি বলেন, ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে মিডিয়ায় দুই দেশের সম্পর্কে গভীর দাগ পড়ার কথা উঠে আসলেও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে আশ্বস্তের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। বার্তা দেওয়া হয়েছে, হ্যাঁ, রাশিয়া ইস্যুতে আমাদের অবস্থান ভিন্ন এবং তা দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এটি ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে বৃহত্তর সহযোগিতাকে বিপথে নিয়ে যাবে না।

ইউক্রেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা মোদি ও ভারতীয় মন্ত্রীরা বারবার তুলে ধরছেন। বাইডেন ও তার প্রশাসনের মন্ত্রীরা দিল্লির অবস্থান বুঝতে পারছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যা ওয়াশিংটনের আগের কঠোর বক্তব্যের চেয়ে ভিন্ন।

ব্লিনকেন বলেছেন, এই সংকট মোকাবিলায় কীভাবে এগোবে সে বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভারতকে। তিনি উল্লেখ করেছেন, জাতিসংঘে ভারত শক্তিশালী বক্তব্য দিয়েছে এবং ইউক্রেনের বুচা শহরে হত্যাকাণ্ডের জন্য স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতের অংশীদার হতে পারেনি তখন রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, সময় বদলে গেছে এবং সম্ভাব্য সব খাতে ভারতের অংশীদার হতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনিয়াত জানান, এই বক্তব্য প্রমাণ করে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের অবস্থান বুঝতে পারছে যুক্তরাষ্ট্র। তার মতে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হলে উভয় পক্ষের হারানোর অনেক কিছুই রয়েছে। এই সম্পর্ক গভীর এবং এই বৈঠকগুলো সেই গভীরতা আশ্বস্ত করেছে মাত্র।

ইউক্রেন ছাড়াও দুই পক্ষ ইন্দো-প্রশান্ত, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে। অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে ভারতকে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র।

ব্লিনকেন বলেন, চীন এই অঞ্চলকে নতুন করে সাজাতে চাইছে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে কাজ করছে।

অঞ্চলটিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় বড় ভূমিকা পালনে একমত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। চীন পরে জানায়, তাদের ৪ সেনা নিহত হয়েছে।

জয়শঙ্কর স্বীকার করেছেন, বৈশ্বিক কল্যাণ এবং ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের বৃহত্তর সুবিধার জন্য ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত কোয়াড একটি প্রভাবশালী শক্তি।

প্রত্যুষ রাওয়ের মতে, কোয়াডের প্রতি ভারতের আস্থার পুনর্ব্যক্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের ঐতিহাসিক মিত্র রাশিয়া কোয়াডের সমালোচনা করে বলেছে, এটি চীনকে নিশানা করে গড়ে ওঠা একটি ফোরাম। সম্প্রতি মস্কো ও বেইজিং অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই যৌথভাবে অবস্থান নিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যুষ রাও বলছেন, প্রকাশ্যে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোয়াডকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটন এতে আশ্বস্ত হবে।

প্রতিরক্ষা সম্পর্ক

ওয়াশিংটন স্বীকার করছে, ভারতের বৃহত্তম প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী রাশিয়া। এই খাতে ভারতের আমদানির ৫০ শতাংশের বেশি আসে রাশিয়া থেকে।

বিপরীতে ২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার পর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০১৬-২০২১ সালে তারা ফ্রান্স ও ইসরায়েলের পেছনে চলে গেছে।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক জিতেন্দ্রনাথ মিসরা জানান, রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত আমদানি অব্যাহত রেখেছে। কারণ, তা অর্থমূল্যে ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ হলো কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তিও স্থানান্তর হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভারতের প্রতিরক্ষা আমদানিতে বড় অংশীদার হতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রযুক্তি স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, মোদি ‘ভারতে তৈরি’ প্রচারণার কথা বলেছেন এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোকে ভারতে শোরুম খোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত বড় কোনও ঘোষণা আসেনি। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছে। যা হলো উভয় দেশ যৌথভাবে ড্রোন উন্নয়নে কাজ করবে।

মিশরা বলেন, ভারতের প্রতিরক্ষার চাহিদা মেটানো এবং মস্কোর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এমন আরও পদক্ষেপ প্রয়োজন।

অবশ্য রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

সূত্র: বিবিসি

ad

পাঠকের মতামত