অসৎ ও অসাধু বিচারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে: প্রধান বিচারপতি
নিউজ ডেস্ক: প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচারকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘অসৎ ও অসাধু বিচারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারকদের দ্বারা সৃষ্ট যাবতীয় অন্যায়ের জন্য এখন থেকে অন্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ বন্ধ করতে হবে। জনগণের জন্য সংক্ষিপ্ত সময়ে সুবিচার নিশ্চিত করতে শতভাগ দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে এ দেশের আপামর জনসাধারণের সাংবিধানিক সব অধিকার সুরক্ষিত করার প্রধান নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট অডিটরিয়ামে দেওয়া ‘বিদায়ি অভিভাষণ’-এ তিনি এসব কথা বলেন। দেশের সব জেলা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের উপস্থিতিতে তাদের উদ্দেশে ‘বিদায়ি অভিভাষণ’ দেন প্রধান বিচারপতি।
সংবিধান অনুযায়ী ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ায় আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সে উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে বিচারকদের বদলির বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পছন্দসই পদায়নের জন্য রাজনৈতিক পদলেহন পরিহার করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আইন বৃহত্তর রাজনীতির একটা অঙ্গ হলেও বিচারকদের রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস রপ্ত করতে হয়। কেবল ক্ষমতাবান শাসকশ্রেণির পক্ষে প্রয়োজনীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব নিলে বিচার বিভাগের আলাদা কোনো অস্তিত্বেরই প্রয়োজন নেই। সে কাজের জন্য নির্বাহী বিভাগ ও পুলিশই যথেষ্ট।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি যে আদর্শকে ধারণ করেই গড়ে উঠুক না কেন, বিচারকদের সুনীতি ও সুবিবেচনা বজায় রেখে কাজ করতে হবে।’
বিচারকদের পদায়ন ও বদলি নিয়ে রেফাত আহমেদ বলেন, ‘বিচারকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অবারিত সুযোগের অন্যতম অনুঘটক ছিল বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকা। এই অনুপস্থিতির প্রতিবিধান করতে আমরা বিচারকদের জন্য বদলি ও পদায়ন নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করেছি। কিন্তু বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত কাজে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রয়োজনীয় সব কাজ এখনো নির্বাহী কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিচালিত হয় বলে এই নীতিমালা আলোর মুখে দেখেনি।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫-এর ধারা ৭ যথাযথভাবে কার্যকর করে পরবর্তী গেজেট প্রজ্ঞাপন যখনই প্রকাশিত হবে, তার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকদের বদলি ও পদায়ন সম্পৃক্ত বঞ্চনা ও বৈষম্য অনেকাংশেই লাঘব হবে বলে আমি মনে করি।’
বিচাকদের পদোন্নতি পরীক্ষার মাধ্যমে করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি রেফাত আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘জেলা আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি এখনও মূলত ব্যাচভিত্তিক বিবেচনায় পরিচালিত হয়। এই বাস্তবতা আজও আমার কাছে এক বিস্ময় হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। বহু বছর আগে নিয়োগ পরীক্ষায় অর্জিত নম্বরই যেন পুরো কর্মজীবনের প্রধান নিয়ামক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন কিংবা দায়িত্ব পালনকালে প্রদর্শিত কর্মদক্ষতার গুণগত ও পরিমাণগত মূল্যায়নের প্রাসঙ্গিকতা তাহলে কোথায়?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদে মামলাজট হ্রাস করতে সত্যিকার অর্থে অগ্রগতি অর্জন করতে চাই, তবে বিচারকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভাগীয় পরীক্ষা ও পারফরম্যান্স মূল্যায়নকে অপরিহার্য মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করার পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সর্বক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠণ করতে হলে এই সত্য স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, অতএব যুগ্ম জেলা জজ হতে তদোর্ধ্ব ক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য ‘সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড’ গঠন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে জেলা জজ ও চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের উদ্দেশ্যে একটি ‘ফিট লিস্ট’ প্রণয়নের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন সহজতর হবে।
মামলাজট নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমার প্রথম অভিভাষণে, আমি বিচার বিভাগের বড় সমস্যা হিসেবে মামলাজট নিয়ে আলোকপাত করেছিলাম। অত্যন্ত স্বল্প সংখ্যক লোকবল ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো স্বত্বেও আমাদের বিচারগণ যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি করেন তা আমার কাছে সবসময় অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। কিন্তু, তাতে বিচারের মান নিয়ে কিছু প্রশ্ন দেখা দেয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘সে কারণে নিষ্পত্তির পরিমাণ ও কাজের গুণগত মান উভয় রক্ষার জন্য আমি শুরুতেই বিচারিক পদ সৃজনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জেষ্ঠ বিচারপতির সভাপতিত্বে ‘পদ সৃজন কমিটি’ সংক্রান্ত আইন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা ২০২৫- প্রণয়নের জন্য আমি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়কে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘উক্ত বিধিমালার আলোকে সর্বশেষ ২৩২টি জেলা জজ পদমর্যাদার পদ সৃজিত হওয়ায় বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজির বিহীনভাবে একসঙ্গে ৮২৬ জন বিচারক পদোন্নতি লাভ করেছেন। সেইসঙ্গে আমি আশা রাখি, খুব শিগগিরই আমাদের প্রস্তাবিত কমার্শিয়াল কোর্ট অধ্যাদেশের আলোকে আরও প্রায় ৭০-টি বিচারিক পদ সৃষ্টি হবে এবং বিচারকের সংখ্যার অনুপাতে মামলার পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে।’
প্রধান বিচারপতি হিসেবে শেষ অভিভাষণে সৈয়দ রেফত আহমেদ, গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যেযব সংস্কার কাংক্রম হাতে নিয়েছিলেন, সেগুলো তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ দেড় বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম করেছি এদেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু আমার বিদায়ের পর বিচার বিভাগের সংস্কারের উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ভবিষ্যত কী হবে, তার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই পদক্ষেপগুলোর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে আপনাদের নীতি ও দায়িত্ববোধের ওপর।’
সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে আয়োজিত আজকের এই সমাপনী অভিভাষণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, দেশের সকল জেলার জেলা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটরা উপস্থিত ছিলেন।










