২০২৫ বৈশ্বিক নারী সম্মেলন: যৌথ ভবিষ্যতের পথে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: চীন ও জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা (UN Women)-এর যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ২০২৫ সালের বৈশ্বিক নারী সম্মেলন (Global Women’s Summit) সফলভাবে শেষ হয়েছে ১৪ অক্টোবর। বেইজিংয়ের শরতের মনোরম আবহে আয়োজিত এ দুই দিনের সম্মেলনটি ১৯৯৫ সালের ঐতিহাসিক বেইজিং নারী সম্মেলনের ৩০ বছর ও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পূর্তির বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয়। “যৌথ ভবিষ্যত: নারীর সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের নতুন অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা”— এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত এ সম্মেলনে ১১০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশ নেন।
চীনের নেতৃত্ব ও কার্যকর প্রতিশ্রুতি
আয়োজক দেশ হিসেবে চীন সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং “চারটি যৌথ অঙ্গীকার” ঘোষণা করেন- অনুকূল উন্নয়ন পরিবেশ সৃষ্টি, উচ্চমানের উন্নয়নের গতি সঞ্চার, অধিকার সুরক্ষার জন্য শাসন কাঠামো গঠন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন অধ্যায় রচনা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে চীন বৈশ্বিক নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও শাসন কৌশলকে নারীর উন্নয়ন এজেন্ডার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
দেশের ভেতরে নারী অধিকার সুরক্ষায় চীন ইতোমধ্যেই ১০০টিরও বেশি আইন ও বিধান প্রণয়ন করেছে। শিক্ষায় লিঙ্গ বৈষম্য প্রায় বিলুপ্ত, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৪০% ছাড়িয়েছে এবং ৬৯ কোটি নারী মধ্যম আয়ের জীবনে পৌঁছেছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে চীন পাঁচটি বড় পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, আগামী পাঁচ বছরে UN Women-কে ১ কোটি ডলার অনুদান, ১০ কোটি ডলারের সাউথ–সাউথ সহযোগিতা তহবিল, নারীদের জন্য ১,০০০টি “ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ” প্রকল্প, ৫০,০০০ নারীকে চীনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ, এবং একটি গ্লোবাল উইমেন’স ক্যাপাসিটি বিল্ডিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা।
বৈশ্বিক ঐক্যমত ও সহযোগিতা
একতরফাবাদ, জলবায়ু সংকট ও বৈষম্যের চ্যালেঞ্জের মুখে এই সম্মেলন হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক ঐক্য ও ভবিষ্যত নির্মাণের প্ল্যাটফর্ম। নারী অধিকার, ডিজিটাল ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু শাসন নিয়ে গভীর আলোচনা শেষে প্রতিনিধিরা একটি দশ দফা কর্মপরিকল্পনায় ঐকমত্যে পৌঁছান।
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছে। আইসল্যান্ড নারী অধিকার আইনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে, সার্বিয়া দেখিয়েছে তাদের সংসদে ৪০ শতাংশ নারী এবং তিন শাখার নেতৃত্বেই নারী। মোজাম্বিক ও কেনিয়ার প্রতিনিধিরা প্রশংসা করেছেন চীনের “যৌথ ভবিষ্যত” ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস চীনের অবদানকে “বেইজিং ঘোষণার বাস্তবায়নে এক মাইলফলক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ফলপ্রসূ উদ্যোগ ও কার্যকর বাস্তবায়ন কাঠামো
সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো “ধারণা–প্রক্রিয়া–প্রকল্প” এই পূর্ণাঙ্গ কাঠামোতে বাস্তবায়িত হবে। গ্লোবাল উইমেন’স সামিটের চেয়ারম্যানের বিবৃতি ৩০ বছর আগের বেইজিং ঘোষণার মূল্যবোধ পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং নতুন যুগের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে লিঙ্গ সমতা, পরিবারবান্ধব নীতি, ও জলবায়ু শাসনে নারীর অংশগ্রহণ।
একটি তিন বছর মেয়াদি মূল্যায়ন ও পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গঠন করা হয়েছে। নতুন প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রটি প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে, যেন ঘোষণাগুলো বাস্তবে রূপ নেয়। প্রকল্প পর্যায়ে চীন–কম্বোডিয়া শিক্ষা সহযোগিতা ও মাতৃ ও শিশুর স্বাস্থ্য প্রকল্প চালু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আফ্রিকান ইউনিয়ন চীনের ডিজিটাল মডেল অনুসরণ করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ চালু করবে। ১০ কোটি ডলারের তহবিলের মাধ্যমে প্রায় ১০ লক্ষ নারী সরাসরি উপকৃত হবেন।
বিশ্বের প্রশংসা বেইজিংয়ের ভূমিকার প্রতি
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ ও বিশেষজ্ঞরা চীনের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। জামিরা আকবাগশেভা বলেছেন, “নারীর উন্নয়ন ক্ষেত্রে চীন এখন বৈশ্বিক নেতা।” সোনিয়া ব্রেসলার বলেছেন, “চীনের ডিজিটাল ক্ষমতায়ন ও তৃণমূল পর্যায়ের মধ্যস্থতা ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে অনুসরণযোগ্য।” রাশিয়ার একাতেরিনা জাক্রিয়াজিমিনস্কায়া বলেছেন, “দশ দফা আহ্বান বৈশ্বিক শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে লিঙ্গসমতাকে স্থাপন করেছে।” মেক্সিকোর লুজ দেল কারমেন কর্দেরো বলেছেন, “চীনের চারটি বৈশ্বিক উদ্যোগ নারীর ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের এক জীবন্ত উদাহরণ।”
নারী উন্নয়নের নতুন যুগের সূচনা
১৯৯৫ সালের বেইজিং ঘোষণার পর ৩০ বছরে চীন এক সক্রিয় অংশগ্রহণকারী থেকে আজ একজন বৈশ্বিক নেতৃত্বে পরিণত হয়েছে। ১,০০০ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন, ৫০,০০০ নারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্তি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে লিঙ্গসমতার সমন্বয়ে এই সম্মেলন বিশ্ব নারী উন্নয়নে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে — যা ভবিষ্যতের সভ্যতার দিকনির্দেশনা গড়ে দেবে।











